বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে মহানবীর মি’রাজ !

মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী:
রাসূলে পাক (সাঃ) এর সশরীরে মি’রাজ বিশ্ব মানবতার ইতিহাসের একটি বিস্ময়কর বাস্তব ঘটনা। ৬২০ খ্রিস্টাব্দে নবুয়তের ১১তম বছরে রজব মাসে ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে রাসূলে পাক (সাঃ) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দাওয়াত পেয়ে স্বর্গীয় বাহন বোরাকে চড়ে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা এবং তথা হতে মানব জ্ঞানের সীমানা পেরিয়ে উর্ধ্বজগতে গমন করে আরশ, কুরসী, লৌহ, কলম ইত্যাদি পরিভ্রমণ করে আল্লাহর সাথে যে একান্ত সান্নিধ্য লাভ করেন তাকে ‘ মি’রাজ’ বলে।
সশরীরে মি’রাজের সত্যতা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে ‘সুবহানাল্লাজি আসরা বিআবদিহি…. অর্থাৎ মহাপবিত্র ও মহিমাময় সত্ত্বা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন। যার চতুর্দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি। যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল (সূরা বনি ইসরাঈল : আয়াত-১) উক্ত আয়াতে ‘আবদ’ শব্দটির ব্যবহার করা হয়েছে। যা রূহ (আত্মা) এবং জাসাদ (শরীর) এর সংমিশ্রণে জীবিত ও জাগ্রত মানুষ হয় আরবী ভাষায় তাঁকেই ‘আবদ’ বলা হয়। কাজেই দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত, রাসূল (সাঃ) এর মি’রাজ সশরীরেই হয়েছে। মি’রাজ সম্পর্কে ২৫ (পঁচিশ) জন বিশিষ্ট সাহাবী সহীহ হাদীস বর্ণনা করেছেন। যাঁরা সকলেই বলেছেন, রাসূল (সাঃ) এর মি’রাজ সশরীরে এবং জাগ্রত অবস্থায়ই হয়েছে। বহু সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, রাসূল (সাঃ) স্বর্গীয় বাহন ‘বোরাকে’ মি’রাজ গমন করেন। ‘বোরাক; আরবী শব্দ। এটি ‘বারকুন’ থেকে উদগত। ‘বারকুন’ শব্দের অর্থ বিদ্যুৎ। স্বর্গীয় বাহন বোরাকের গতি বিদ্যুতের চেয়েও দ্রুত ছিল বলে ইহাকে ‘বোরাক’ বলা হয়। ইহা দৃষ্টিসীমায় পা রাখত। ইহা এক লাফে দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করতে পারতো।
রাসূল (সাঃ) এর মি’রাজ স্বপ্নে হলে বোরাকের কোনো প্রয়োজনই হতো না। বোরাক চড়ে মি’রাজ গমন করায় সুস্পষ্ট প্রমাণ হল রাসূল (সাঃ) সশরীরে এবং জাগ্রত অবস্থায় মি’রাজ গমন করেছেন। সশরীরে মি’রাজের ঘটনাটি সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর (রাঃ) বিশ্বাস করেন বলেই রাসূল (সাঃ) হযরত আবু বকরকে ‘সিদ্দিক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ফলে হযরত আবু বকরের মর্যাদা এমন উচ্চমানের হলো, সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদীর ঈমান যদি এক পাল্লায় রাখা হয় এবং আবু বকরের ঈমান এক পাল্লায় রাখা হয় তাহলে আবু বকরের ঈমানের পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। হযরত আবু বকর (রাঃ) এত মর্যাদাবান হয়েছেন রাসূল (সাঃ) এর সশরীরে এবং জাগ্রত অবস্থায় মি’রাজকে সর্বপ্রথম বিশ্বাস করার কারণেই। পক্ষান্তরে কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকরা রাসূল (সাঃ) এর সশরীরে মি’রাজকে অস্বীকার করে এ ব্যাপারে চরম বিতর্কের সৃষ্টি করে। মি’রাজ স্বপ্নযোগে হলে এসব বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। কারণ স্বপ্নযোগে সেকেন্ডে কোটি কোটি মাইল অতিক্রম করাটা সকলের নিকট স্বীকৃত।
রাসূল (সাঃ) এর সশরীরে মি’রাজ বিজ্ঞানসম্মত কিনা এ নিয়ে কেউ কেউ বিতর্ক করে থাকেন। যারা বলেন, সশরীরে এবং জাগ্রত অবস্থায় মি’রাজ বিজ্ঞানসম্মত নয়-এরা মূলত আল্লাহর অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, এরা কম জ্ঞানের অধিকারী। আল্লাহর অসীম ক্ষমতার বিষয়টি মানবজ্ঞান দ্বারা বুঝবেই বা কী করে? কোরআনের কোনো বিষয়ই বিজ্ঞান বহির্ভূত নয়। রাসূল (সাঃ) এর প্রতিটি কথা ও কাজকে আধুনিক বিজ্ঞান অকুন্ঠ সমর্থন করেছে। এক কথায় কোরআন-হাদীসে যাহাই আছে সবই বিজ্ঞানসম্মত। রাসূল (সাঃ) এর সশরীরে এবং জাগ্রত অবস্থায় মি’রাজের ঘটনাটিও কোরআনের আয়াত ও অগণিত সহীহ হাদীস দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত। রাসূল (সাঃ) এর সশরীরে মি’রাজকেও আধুনিক বিজ্ঞান অকুন্ঠ সমর্থন করেছে। কোরআন-হাদীসের সকল বিষয়ের পাশে বিজ্ঞানকে দাড় করানো ঠিক হবে না। কারণ অনেক কিছু আছে যা আল্লাহর অপরিসীম শক্তিতে হয়ে যায়। এসব কিছু বিজ্ঞান সমর্থন করে না বলে কি আমরা আল্লাহর অপরিসীম ক্ষমতাকে অস্বীকার করব? না, কখনও না। মূলত এসব কিছুতেই আধুনিক বিজ্ঞানের অকুন্ঠ সমর্থন আছে। কিন্তু তা আমরা বুঝিনা, বুঝার চেষ্টাও করিনা।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে আগুনে নিক্ষেপ করার পরও তিনি সম্পূর্ণ অক্ষত রয়ে গেলেন, হযরত মুসা (আঃ) এর লাঠি মোবারক মাটিতে ফেলে দেয়ায় তা একটি বিরাট সাপে পরিণত হয়ে গেল, রাসূল (সাঃ) এর পবিত্র আঙ্গুল মোবারকের ইশারায় চন্দ্র দ্বিখন্ড হয়ে গেল-এসব বিষয় কোরআন-হাদীস দ্বারাই সুস্পষ্ট প্রমাণিত। এখন কেউ বলতে পারে, এসব তো বিজ্ঞান মানে না। আমি প্রশ্ন করবো, বিজ্ঞান মানে না বলে কি আমরা এসব অস্বীকার করবো? না, আমরা এসব কখনও অস্বীকার করবো না। কারণ উপরোক্ত ঘটনাবলী হচ্ছে নবী-রাসূলগণের মোজেজা। আর নবী-রাসূলগণ থেকে মানব বিবেক বহির্ভূত যেসব ঘটনাবলী প্রকাশ পায় তাকে মোজেজা বলে। মোজেজার কাছে মানব বিবেক সব সময়ই পরাজিত, বিজ্ঞান সব সময়ই ব্যর্থ। মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতা বলে নবী-রাসূল থেকে মোজেজা প্রকাশ পায়। সেই ক্ষমতার কাছে বৈজ্ঞানিকদের তন্ত্রমন্ত্র একেবারেই তুচ্ছ।
আল্লাহপাক যে কোনো কিছু করার ইচ্ছে করলে শুধু বলবেন ‘হয়ে যাও, তখনই হয়ে যাবে।’ এর মোকাবেলা করার ক্ষমতা দুনিয়ার কোনো বৈজ্ঞানিকের নেই, হতেও পারে না। সুতরাং আল্লাহ প্রদত্ত নবী-রাসূল থেকে প্রকাশিত মোজেজার সামনে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুক্তিকে দাড় করানো মোটেই সঠিক হবে না। সশরীরে এবং জাগ্রত অবস্থায় মিরাজ রাসূল (সাঃ) এর একটি বিশেষ মোজেজা। রাসূল (সাঃ) এর মিরাজ সশরীরে এবং জাগ্রত অবস্থায় হওয়ার কয়েকটি বৈজ্ঞানিক যুক্তি হচ্ছে :-
(১) বিজ্ঞান জগতে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিষয় হলো-Theosophy বা ঈশ্বর রহস্য। এ বিষয়ে বিখ্যাত মনীষী এ্যানি বেসাল্ট তার লেখা Man and his bodies নামক গ্রন্থে জড়দহ ছাড়াও মানুষকে তিন রকম দেহের অধিকারী বলেছেন। যেমন-(১) Astral Body বা জ্যোতির দেহ। (২)Mental Body বা মানব দেহ। (৩) Cassal Body বা নিমিত্ত দেহ। দেহ হলো আত্মার পোশাক। প্রয়োজনে আত্মা বিভিন্ন দেহকে ব্যবহার করতে পারে। মানুষের স্থুলদেহ ছাড়াও উক্ত যে তিনটি দেহ আছে তারা প্রয়োজনে বিভিন্ন গতি প্রাপ্ত হতে পারে। এমনকি নিমিত্ত দেহের গতি আলোর গতির চেয়েও অনেক বেশি। যে ব্যক্তি তাঁর প্রত্যেকটি দেহের উপর আত্মার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে তার পক্ষে দেহগুলোকে বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করাটা তেমন অসম্ভব কাজ নয়। আর রাসূল (সাঃ) এর পক্ষে দেহের উপর আত্মার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করাটা নিতান্তই স্বাভাবিক। তাই রাসূল (সাঃ) এর মিরাজ সশরীরে এবং জাগ্রত অবস্থায় হওয়া কোনো অসম্ভব ব্যাপার নহে (মাসিক পরওয়ানা : অক্টোবর-২০০০)। (২) রাসূল (সাঃ) কে বাহ্যিক দিক থেকে জড়বাদী মানুষরূপে দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি জড়বাদী ছিলেন না। বরং তাঁর পবিত্র দেহ মোবারক নূর বা জ্যোতি দ্বারা গঠিত। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আমি আল্লাহর নূর এবং সবকিছুই আমার নূর হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই নূরের তৈরি সৃষ্টি মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ভেদ করা কখনও অসম্ভব নহে। মোট কথা, রাসূল (সাঃ) এর সশরীরে এবং জাগ্রত অবস্থায় মিরাজ আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত।