ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় জয়।

মেহেদী হাসান মিরাজের অসাধারণ ব্যাটিংয়ের কারণেই ভারতের বিপক্ষে এক অবিস্মরণীয় জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এক উইকেটে হারিয়েছে ভারতেকে। বলতে গেলে ভারতের জয় একাই ছিনিয়ে এনেছেন মিরাজ। এই জয়ে ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে ঐতিহাসিক জয় দিয়ে শুরু করেছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে ভারতের বিপক্ষে এটা ষষ্ঠ জয় টাইগারদের। ফলে ২০১৫ সালের পর ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ। গতকাল মিরপুরে প্রথম ওয়ানডেতে ভারতের ছুঁড়ে দেয়া ১৮৭ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে এক পর্যায়ে ১৩৬ রানেই নবম উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
জয়ের জন্য শেষ ৬৩ বলে শেষ উইকেট হাতে নিয়ে ৫১ রান দরকার ছিল বাংলাদেশের। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ম্যাচ জয়ের আশা একেবারেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ উইকেটে মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে ৪১ বলে অবিচ্ছিন্ন ৫১ রান তুলে বাংলাদেশকে ১ উইকেটের অবিস্মরণীয় জয় দেন মিরাজ। ৩৯ বলে অপরাজিত ৩৮ রান করে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন অলরাউন্ডার মিরাজ। ১০ রানে অপরাজিত থাকেন মুস্তাফিজ। ফলে সিরিজে তিন ম্যাচ সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। গতকাল টস জিতে ভারতকে আগে ব্যাট করার সুযোগ দেন বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক হওয়া বাংলাদেশের লিটন দাস।
আগে ব্যাট করতে নেমে টাইগার বোলারদের সামনে মত্র ১৮৬ রানে অলআউট হয় ভারত। ফলে জয়ের জন্য বাংলাদেশ পায় ১৮৭ রানে টার্গেট। জয়ের জন্য ১৮৭ রানের জবাব দিতে নেমে শুরুটা কিন্তু ভালে হয়নি বাংলাদেশের। ইনিংসের প্রথম বলেই উইকেট হারায় টাইগাররা। ভারতীয় পেসার দীপক চাহারের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে খালি হাতে বিদায় নেন ওপেনার নাজমুল হোসেন শান্ত। শান্তর বিদায়ে ক্রিজে আসেন এনামুল হক বিজয়। বাউন্ডারি দিয়ে ইনিংস শুরু করলেও, বেশিক্ষণ উইকেটে থাকতে পারেননি এনামুল। মোহাম্মদ সিরাজের বলে শর্ট মিড উইকেটে সুন্দরকে ক্যাচ দিয়ে ২৯ বলে ২টি চারে ১৪ রান করে আউট হন বিজয়। লিটনের সাথে জুটিতে ২৬ রান যোগ করেন বিজয়। ২৬ রানে ২ উইকেট পতনের পর উইকেটে জুটি বাঁধেন অধিনায়ক লিটন ও সাকিব। ভারতের বোলারদের সামলে নিয়ে রানের চাকা ঘুড়াতে থাকেন তারা। ১৫তম ওভারে দলের রান হাফ-সেঞ্চুরিতে নেন লিটন ও সাকিব। ২০তম ওভারে লিটন-সাকিব জুটি ভাঙ্গেন ভারতের স্পিনার সুন্দর। ফাইন লেগ দিয়ে খেলতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন ৩টি চার ও ১টি ছক্কায় ৪১ রান করা লিটন। ৬১ বলে ৪৮ রানের জুটি গড়েন লিটন-সাকিব।
বাংলাদেশের রান ১শ স্পর্শ করার আগেই বিদায় নেন সাকিব। সুন্দরের বলে এক্সট্রা কভারে কোহলির হাতে ধরা পড়ার আগে ৩টি চারে ৩৮ বলে ২৯ রান করেন সাকিব। দলীয় ৯৫ রানে চতুর্থ ব্যাটার হিসেবে সাকিবের আউটে চিন্তায় পড়ে বাংলাদেশ। সেই চিন্তা দূর করতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদুল্লাহ। উইকেট ধরে খেলতে থাকেন তারা। এক-দুই রানেই সন্তুস্ট ছিলেন মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহ। তাদের ধীরলয়ের ব্যাটিংয়েও আস্কিং খুব বেশি বাড়েনি। ৩৫তম ওভারের শেষ বলে মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ জুটি ভেঙ্গে ভারতকে ব্রেক-থ্রু এনে দেন শারদুল ঠাকুর।
আম্পায়ারস কলে লেগ বিফোর আউট হন ৩৫ বলে ১৪ রান করা মাহমুদুল্লাহ। পরের ওভারের প্রথম বলে বিদায় ঘটে মুশফিকেরও। সিরাজের বলে এড হয়ে বোল্ড হন মুশফিক। ৪৫ বলে ১৮ রান করেন তিনি। পঞ্চম উইকেটে ৬৯ বলে ৩৩ রানের জুটিতে মুশফিক-মাহমুদুল্লাহর কোন বাউন্ডারি বা ওভার বাউন্ডারি মারতে পারেননি। দুই বলে দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে বাংলাদেশ। মাহমুদুল্লাহ-মুশফিক যখন বিদায় নেন তখন ৪ উইকেট হাতে নিয়ে ৮৯ বলে ৫৯ রান দরকার পড়ে। ৩৯তম ওভারে দুই উইকেট শিকার করে বাংলাদেশকে হারের পথে ঠেলে দেন অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামা পেসার কুলদীপ সেন। আফিফ হোসেন ৬ ও এবাদত কোন রান করতে পারেননি। পরের ওভারে হাসানকে থামান সিরাজ। অর্থাৎ ১২৮ থেকে ১৩৬, ৮ রানের ব্যবধানে ৫ উইকেট হারায় টাইগাররা। ১৩৬ রানে ৯ উইকেট পতন ঘটে বাংলাদেশের।
এতে টাইগারদের হার সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ৪১তম ওভারে ২টি ছক্কা মেরে বাংলাদেশকে শেষবারের মত আশায় রাখেন মিরাজ। ৪৩তম ওভারের দ্বিতীয় বলে মিরাজের সহজ ক্যাচ ফেলেন উইকেটরক্ষক রাহুল। তখন ১৫ রানে ছিলেন মিরাজ। বাংলাদেশের দরকার ছিলো ৩২ রান। ৪৪তম ওভারে ৩টি চার মারেন মিরাজ। ৪৫তম ওভারে ১টি চার আদায় করে নেন তিনি। ৪৫ ওভার শেষে ৮ রান দরকার পড়ে বাংলাদেশের। ৪৬তম ওভারের প্রথম বলে চার মারেন মিরাজ। ওভারের পরের পাঁচ বল থেকে চার রান নিয়ে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন মিরাজ ও মুস্তাফিজ। শেষ উইকেটের জুটিতে মিরাজ-মুস্তাফিজ ৫১ রান যোগ করেন।
জুটিতে ৩০ বলে ৩৭ রান অবদান ছিলো মিরাজের। শেষ পর্যন্ত ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় ৩৯ বল খেলে অপরাজিত ৩৮ রান করেন মিরাজ। ভারতের সিরাজ ৩২ রানে ৩ উইকেট নেন। এর আগে ব্যাট করতে নেমে ব্যাট হাতে ভালো শুরুর ইঙ্গিত দিয়ে বড় জুটি গড়তে পারেননি ভারতের দুই ওপেনার অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও শিখর ধাওয়ান।
উইকেটের অবস্থা বুঝে চতুর্থ ওভারেই স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজকে আক্রমণে আনেন দলনেতা লিটন। নিজের দ্বিতীয় ওভারেই ধাওয়ানকে বোল্ড করেন মিরাজ। রির্ভাস সুইপ করতে গিয়ে আউট হয়ে ৭ রানে ফিরেন ধাওয়ান। তিন নম্বরে নামা বিরাট কোহলিকে নিয়ে জুটির চেষ্টা করেন রোহিত। দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করেন তারা। ভারতের দুই সেরা ব্যাটারকে আটকাতে আবারও চমক দেখান লিটন। ১১তম ওভারেই সাকিব আল হাসানকে আক্রমণে আনেন লিটন। নিজের প্রথম ওভারেই রোহিত কোহলিকে তুলে নেন সাকিব।
১১তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ডিফেন্সিভ খেলতে গিয়ে বোল্ড হন রোহিত। চতুর্থ বলে শর্ট কাভারে উপর দিয়ে মারতে গিয়ে লিটনের দুর্দান্ত ক্যাচে বিদায় নেন কোহলি। ডান-দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দারুন ক্যাচ নেন লিটন। রোহিত ২৭ ও কোহলি ৯ রান করেন। ৪৯ রানে ৩ উইকেট পতনের পর দলের হাল ধরেন শ্রেয়াস আইয়ার ও লোকেশ রাহুল। বড় জুটি গড়ার পথে ছিলেন তারা। আইয়ার-রাহুলের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান বাংলাদেশের পেসার এবাদত হোসেন। ২০তম ওভারের শেষ বলে আইয়ারকে আউট করেন তিনি। অফ স্টাম্পের বাইরের বল পুল করতে গিয়ে মুশফিককে ক্যাচ দেন আইয়ার। ২৪ রান করেন আইয়ার। চতুর্থ উইকেটে ৫৬ বলে ৪৩ রান যোগ করেন তারা। পঞ্চম উইকেটে ওয়াশিংটন সুন্দরকে নিয়ে ৭৫ বলে ৬০ রান যোগ করেন রাহুল। এই জুটি এত বড় হতো না, যদি ২৮তম ওভারে মিরাজের বলে লং-অফে সুন্দরের ক্যাচ না ফেলতেন এবাদত। তখন ১২ রানে ছিলেন সুন্দর। পরে ৩৩তম ওভারে সুন্দরকে ফেরান সাকিব। নিজের ষষ্ঠ ওভারে তৃতীয় উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় ব্রেক-থ্রু এনে দেন সাকিব।
রির্ভাস-সুইপ করে পয়েন্টে এবাদতকে ক্যাচ দেন সুন্দর। ৪৩ বলে ১৯ রান করেন সুন্দর। দলীয় ১৫২ রানে পঞ্চম ব্যাটার হিসেবে সুন্দরের বিদায়ের পর বেশি দূর যেতে পারেনি ভারত। ৪২তম ওভারে ১৮৬ রানে গুটিয়ে যায় ভারত। শেষ ৫ উইকেটের মধ্যে এবাদত ৩টি ও সাকিব ২টি উইকেট নেন। ভারতের দীপক চাহারকে শিকার করে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে চতুর্থবারের মত পাঁচ উইকেট নেন সাকিব। পুরো ১০ ওভার বল করে ৩৬ রানে ৫ উইকেট নেন সাকিব। ভারতের বিপক্ষে এটিই তার সেরা বোলিং ফিগার। ওয়ানডেতে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেই ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করেছেন এবাদত। ৮ দশমিক ২ ওভার বল করে ৪৭ রানে ৪ উইকেট নেন এবাদত। টপ-অর্ডারের ব্যর্থতার মাঝে ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করেন রাহুল। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১১তম হাফ-সেঞ্চুরির ইনিংসে ৭৩ রান করেন তিনি। ৭০ বল খেলে ৫টি চার ও ৪টি ছক্কা মারেন রাহুল। রাহুলের ইনিংসের সুবাদেই সম্মানজনক স্কোর পেয়েছে ভারত। আগামী ৭ ডিসেম্বর এই ভেন্যুতেই সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আবারও ভারতের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।
তথ্যসূত্র : সংগ্রাম।