আজ হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর মৃত্যু বার্ষিকী।

আজ মরহুম স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০১ সালের ১০ জুলাই তিনি ঢাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে , বাঙালির শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় তিনি সিক্ত হয়ে থাকবেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে ছিল তার অবিচল নিষ্ঠা ও বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল তার প্রগাঢ়তম শ্রদ্ধাবোধ ও আস্থা। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে ঘটেছিল জাতির জীবনের কলঙ্কতম ও নিষ্ঠুরতম ট্র্যাজেডি। বিশ্বাসঘাতক কতিপয় দুর্বৃত্তের বর্বরোচিত পাশবিক হামলায় জাতি হারিয়েছিল তাদের পিতাকে, মাতাকে। এই পরিবারের কেউই রক্ষা পাননি সেই নরঘাতকদের ঘৃণ্য ছোবল থেকে। আল্লাহতায়ালার অশেষ মেহেরবানিতে বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন বিদেশে। ওই সময় দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য এবং রাষ্ট্রীয় সুবিধাপ্রাপ্ত অনেকেরই আচরণ আমাদের দারুণভাবে হতাশ করেছে , কিন্তু সেই ক্রান্তিলগ্নে নির্ভয় হুমায়ুন রশীদ প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মতো স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে এলেন পরম শোকাহত ও চরম বিপদগ্রস্ত বঙ্গবন্ধুতনয়াদের সহায়তা প্রদানে। সে কাহিনি আজ সবার জানা। প্রাথমিক সেই সহযোগিতার মূল্য ছিল অপরিসীম। শেখ হাসিনা ও রেহানাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ওপর ক্ষিপ্ত হয় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। ঘাতকেরা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রদূত থেকে প্রত্যাহার করে দেশে এনে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল; কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশের পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় প্রাণে রক্ষা পান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। পরে তাকে ওএসডি করে দেশে নিয়ে আসা হয়। তিনি ১১ মাস ওএসডি ছিলেন।
একটি শিক্ষিত আলোকিত প্রগতিশীল পারিবারিক পটভূমে হুমায়ুন রশীদের জন্ম হয়েছিল সিলেটে, ১৯২৮ সালে। তার মা বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছিলেন নারীমুক্তি ও নারী শিক্ষা বিস্তারে এক খ্যাতনামা অগ্রপথিক। বাবা মরহুম আবদুর রশীদ ছিলেন আসাম সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা। পরে চাকরি ত্যাগ করে তিনি চা-শিল্পে জড়িয়ে পড়েন। বাবা-মা দুজনই সমাজকল্যাণমূলক কাজে এবং প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন।
শিলংয়ে স্কুল অধ্যয়ন এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্ব শেষে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান।
১৯৫৩ সালে তিনি তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন। শিক্ষানবিশকালীন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা টাফ্ট্স্ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসিতে অধ্যয়ন করে ডিগ্রি লাভ করেন। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক আয়োজিত সুপরিকল্পিত ট্রেনিং প্রোগ্রামের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসে শিক্ষামূলক সংযুক্তি, বিভিন্ন সরকারি বিভাগে ট্রেনিং, পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান পরিচিতি সফর এবং বিদেশি ভাষা শিক্ষা। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী অবশ্য ভাষা-শিক্ষার বিষয়ে আগ্রহ ও দক্ষতা ছিল। তিনি ইংরেজি-বাংলা ছাড়াও উর্দু, ফরাসি ও ইতালিয়ান ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। আরবি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, জার্মান ও ভাষা ইন্দোনেশিয়াতেও তার গ্রহণযোগ্য ব্যুৎপত্তি ছিল। পাকিস্তান সরকারের অধীনে তিনি রোম, বাগদাদ, প্যারিস, লিসবন, জাকার্তা দূতাবাস ও দিল্লি হাইকমিশনে দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৭১ সালে তিনি দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে কর্মত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েই দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের চার্জ-দ্য-অ্যাফেয়ার্স বা হাইকমিশনের ভারপ্রাপ্ত নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি অন্যান্য দেশ কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা করে যান।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানিতে নিযুক্ত হন। তখন তিনি অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডেও রাষ্ট্রদূতের যুগপৎ দায়িত্ব পালন করেন। জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সৌদি আরবেও বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। তখনো তিনি জর্ডান ও ওমানে যুগপৎ রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন এবং ওআইসিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ও জুন ১৯৮২-তে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের হাইকমিশনার নিযুক্ত হন। প্রেসিডেন্ট এরশাদের ক্ষমতাকালীন তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অষ্টম অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও গুরুত্বপূর্ণ আন্তরাষ্ট্রীয় আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের চতুর্দশ অধিবেশনের তিনি ছিলেন সভাপতি।
মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অনুরোধে সরাসরি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সিলেট-১ আসন থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।
তিনি ১৯৯৬ সালের ১৪ জুলাই বাংলাদেশ পার্লামেন্টের স্পিকার নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে তিনি তার দায়িত্ব পালন করে সকলের শ্রদ্ধ ও আস্থা অর্জন করেন ।
কোম্পানীগঞ্জ তুলনামূলকভাবে একটি অবহেলিত উপজেলা ছিল। সিলেট-১-এর জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে এমপি হিসেবে তিনি কোম্পানীগঞ্জের এবং সমগ্র নির্বাচনী এলাকার বিপুল অবকাঠামোসহ সকল ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড করে ,মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন । আজও কোম্পানীগঞ্জের মানুষ তার অভাব অনুভব করে ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।