দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা …..!

মাতৃভাষার জন্যে জীবন উৎসর্গ করা জাতি হিসেবে মনে হয় আমরাই একমাত্র ! উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মেনে না নেয়ার পরিণাম আমরা দেখেছি ৫২তে। বিরোধীতা করার ফল স্বরূপ পাকিস্তানী বর্বরদের গুলিতে ঝাঁজরা হয়েছেন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার সহ আরো অনেকে। ভাষা আন্দোলন দিয়ে যে স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিলো, তার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে।
স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জিত হয়েছে, কিন্তু বাংলা ভাষা কি আদৌ তার মর্যাদার আসন পেয়েছে ? আমরা কি পেরেছি মাতৃভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে ?
যতদূর মনে পড়ে, গত বিশ বছর ধরে এই আলোচনা বিভিন্ন মাধ্যমে সরগরম হয়ে আছে। শিশুদেরকে প্রাথমিক বাংলা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে ইংরেজী মাধ্যমে ঠেলে দেয়া বাংলা ভাষার সংকুচিত হওয়ার একটি অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন। বড় শহর, মফস্সল, এমনকি গ্রামেও আজকাল কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সব অভিভাবকই চান যে তার সন্তান আন্তর্জাতিক ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠুক। উচ্চ শিক্ষা সহ পরবর্তী জীবনের সাফল্যের কথা ভেবেই বাবা মারা এই ধরণের পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। বাংলা দেশীয় ভাষা, এটা এমনিতেই শিখবে। এই এমনিতেই শিখবের পরিনাম পরবর্তীতে যে কি ভয়াবহ রুপ ধারণ করে তা আজকালকার বাচ্চাদের কথা শুনলেই বুঝা যায়।
কিছুদিন আগে ঢাকা ভিত্তিক একটি বাণিজ্যিক বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনছিলাম। অনুষ্ঠানটিতে উপস্থাপক বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বিকৃত উচ্চারণে বাংলায় কথা বলছিলেন ! কিছু কিছু উচ্চারণ এতটাই বিবর্তিত ছিলো যে প্রায় অশ্লীল শুনাচ্ছিলো ! ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার আদলে কেন বাংলাকে তুলে ধরতে হবে, আমার ঠিক বোধগম্য নয় ? শ্রোতাদের অবস্থাও দেখলাম একই রকম। যারা শুনছেন, তাদের বয়স আনুমানিক কৈশোর থেকে যৌবনের মধ্যে। ফোন করে একেকজন অভিব্যক্তি জানাচ্ছিলেন যার অধিকাংশই ইংরেজী বাংলার সংমিশ্রণ ! কেউ কেউতো আবার হিন্দি শব্দও জুড়ে দিচ্ছিলেন।
সংস্কৃতিতো অনেক আগেই ভিন্ন মাত্রা বেছে নিয়েছে, এখন ভাষাটাও যাচ্ছে। কাদের অবজ্ঞার ফলে এই পরিণতি ? মাতৃভাষার জন্যে প্রাণ দেয়া জাতি আজ ভাষা থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। উন্নত বিশ্বের অন্তত পক্ষে ৫০টি দেশের উদাহরণ দেয়া যাবে যারা তাদের মাতৃভাষাকে আঁকড়ে ধরেই সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে গেছে।
সে সকল দেশে, অণু পর্যায় থেকেই মাতৃভাষার প্রতি অনুভূতির বীজ বপন করা হয়। ভাষার প্রতি, দেশের প্রতি আকুন্ঠ টান থাকে তাদের জীবন ভর। আমাদের অবস্থান ঠিক এর বিপরীত মুখী। ভাষার প্রতি অবজ্ঞা যেখানে সর্বজনবিদীত, সেখানে রাষ্ট্রীয় অনুভূতি আশা করাটাই বোধহয় বিলাসীতা।
অমর গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী আব্দুল লতিফের একটি গান আমাকে প্রায়ই আরষ্ট করে তুলে। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন মঞ্চ, পথ নাটক ও জাতীয় দিবসগুলিতে প্রাণ খুলে গাইতাম আর ভাবতাম আহা ! কি মধুর কি সমৃদ্ধ ভাষাই না আমাদের অগ্রজরা উপহার দিয়ে গেছেন ? দুই দশক ধরে দেশের বাইরে থেকেও আমার চিৎকার করে গাইতে ইচ্ছে করে “ দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা .. কারো দানে পাওয়া নয় ….!”
সৈয়দ মিনহাজুল ইসলাম (শিমুল) ।
নির্বাহী সম্পাদক।