পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসি ও আলিমের সবাই উত্তীর্ণ।

অবশেষে পরীক্ষা ছাড়াই প্রকাশিত হলো এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষার ফল। মহামারিকালে আগের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের মূল্যায়নে সবাইকে পাস করানো হয়েছে; জিপিএ-৫ পেয়েছে দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। পরীক্ষা না নিয়ে ফল প্রকাশে আইন সংশোধনের পর গতকাল শনিবার একযোগে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়, যাতে পৌনে ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর অপেক্ষার অবসান ঘটে। এইচএসসি ও সমমানে গত বার অর্থাৎ ২০১৯ সালে পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। তার আগের বছর ছিল ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন শিক্ষার্থী। গতবার এই সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার ২৮৬। তার আগের বছর ছিল ২৯ হাজার ২৬২।
গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠানে এই ফল প্রকাশ হয়। বেলা পৌনে ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে গণভবন থেকে অনলাইনে ফল ঘোষণার উদ্বোধন করেন। শিক্ষামন্ত্রী ছাড়াও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং সব শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে এইচএসসির ফলাফলের সারসংক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিশেষ পরিস্থিতিতে এই ভাবে ফল প্রকাশের বিষয়টি তুলে ধরে পরীক্ষাহীন এই ফল নিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে বিরূপ মন্তব্য না করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, সাধারণ ও মাদরাসা বোর্ডের ক্ষেত্রে জেএসসি ও সমমান এবং এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার বিষয়গুলোকে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার বিষয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ফলাফল প্রস্তুত করা হয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ক্ষেত্রে এসএসসি ও সমমান এবং একাদশ শ্রেণির পরীক্ষার বিষয়গুলোকে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার বিষয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রস্তুত হয়েছে ফল।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পরামর্শক কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফল প্রকাশ করা হয়। সমন্বয়কৃত বিষয়ের প্রাপ্ত নম্বরের গড় মানের ভিত্তিতে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার বিষয়ভিত্তিক নম্বর প্রতিস্থাপন করে বিদ্যমান পদ্ধতিতে গ্রেড পয়েন্ট নির্ধারণের মাধ্যমে জিপিএ চূড়ান্ত করা হয়। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গ্রুপ বা বিভাগ পরিবর্তনকারী পরীক্ষার্থী, বোর্ড পরিবর্তনকারী পরীক্ষার্থী, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত পরীক্ষার্থী, অনিয়মিত পরীক্ষার্থী, মানোন্নয়ন পরীক্ষার্থী, সমতুল্য সনদপ্রাপ্ত পরীক্ষার্থী ও প্রাইভেট পরীক্ষার্থীদের ফলাফল পরামর্শক কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে করা হয়। ফলাফলে কোনো শিক্ষার্থী সংক্ষুব্ধ হলে রিভিউ চেয়ে আবেদন করতে পারবে, বলেন দীপু মনি। তিনি জানান, এবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা না হওয়ায় পরীক্ষার্থীদের ফরমপূরণ বাবদ আদায়কৃত অর্থের অব্যয়িত অংশ ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যদি মূল্যবোধ তৈরি না হয়, তাহলে শুধু বেশি নম্বর পেয়ে কী হবে, মানবিক গুণে গুণান্বিত হও; চারপাশে তাকাও- মানুষকে ভালবাসো। নীতি নৈতিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠো, স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হও, নিঃস্বার্থ চিত্তে মানব কল্যাণে নিবেদিত হও।
দীপু মনি অভিভাবকদের প্রতি বলেন, আপনার সন্তানকে অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেবেন না, স্বার্থপর হিসেবে গড়ে তুলবেন না। দেশের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হওয়ার শিক্ষা যদি আপনার সন্তান না পায়, মনে রাখবেন এ শিক্ষা অর্থবহ হবে না, শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।
শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যারা শিক্ষকতা পেশায় আছেন, আপনাদের দায়িত্ব অনেক অনেক বেশি। শিক্ষার গুণগত পরিবর্তনে বিষয়ভিত্তিক মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে আপনাদের ভূমিকাই প্রধান। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রেও আপনারাই রাখতে পারেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
এএইচএসসি-সমমানের ফলের পরিসংখ্যান বলছে, জেএসসি এবং এসএসসিতে জিপিএ-৫ না পেয়ে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৫৭০ জন। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ১৫৭ জন। অপরদিকে, জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ২০১৯ সালের এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাননি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজার ৮৬৫ জন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার ৬৩৪ জন।
বেড়েছে জিপিএ-৫: গত বছরের চাইতে এবার সাড়ে তিনগুণ জিপিএ-৫ বেড়েছে। এবার ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন জিপিএ-৫ পেয়েছেন। তার মধ্যে ৮৩ হাজার ৩৩৮ জন মেয়ে আর ছেলেদের মধ্যে ৭৮ হাজার ৪৬৯ জন রয়েছেন। জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে ছেলেদের চাইতে ৪ হাজার ৮৬৯ জন মেয়ে এগিয়ে রয়েছেন।
তবে জেএসসি-এসএসসির ভিত্তিতে এইচএসসির ফলাফল নির্ণয় করা হলেও দুই স্তরে জিপিএ-৫ পেয়েও ৩৯৬ জন জিপিএ-৫ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। দুই স্তরে পিছিয়ে থাকলেও ১৭ হাজার ৪৩ জন এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
জিপিএ-৫ এ এগিয়ে ছাত্রীরা, শীর্ষে ঢাকা বোর্ড: এবার ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ৩ লাখ ২৬ হাজার ৪১ জন। এর মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৯২৬ জন শিক্ষার্থী। রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ১ লাখ ৪৯ হাজার ৯৭৬ জন, জিপিএ ৫ পেয়েছেন ২৬ হাজার ৫৬৮ জন। কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিলেন এক লাখ ২ হাজার ৪৩৪ জন, জিপিএ ৫ পেয়েছেন ৯ হাজার ৩৬৪ জন। যশোর শিক্ষাবোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিলেন এক লাখ ২১ হাজার ৫২৮ জন, জিপিএ ৫ পেয়েছেন ১২ হাজার ৮৯২ জন। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিলেন ৯৭ হাজার ৯৬৭ জন, জিপিএ ৫ পেয়েছেন ১২ হাজার ১৪৩ জন।
বরিশাল শিক্ষাবোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিলেন ৬৮ হাজার ৯২০ জন, জিপিএ ৫ পেয়েছেন ৫ হাজার ৫৬৮ জন। সিলেট বোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিলেন ৭৫ হাজার ৩২৩ জন, জিপিএ ৫ পেয়েছেন ৪ হাজার ২৪২ জন। দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিলেন এক লাখ ১৮ হাজার ৭৩৫ জন, জিপিএ ৫ পেয়েছেন ১৪ হাজার ৮৭১ জন। ময়মনসিংহ শিক্ষাবোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিলেন ৮৪ হাজার ৪০৫ জন, জিপিএ ৫ পেয়েছেন ১০ হাজার ৪০ জন। কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন এক লাখ ৩৩ হাজার ৭৪৬ জন, জিপিএ ৫ পেয়েছেন চার হাজার ১৪৫ জন। এবং মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে ৮৮ হাজার ৩০২ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। এর মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছেন চার হাজার ৪৮ জন শিক্ষার্থী।
১১টি শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮৩ হাজার ৩৩৮ জন ছাত্রী এবং ছাত্র ৭৮ হাজার ৪৬৯ জন ছাত্র। সেই হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রদের থেকে চার হাজার ৮৬৯ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
১১টি শিক্ষা বোর্ডের ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন শিক্ষার্থীর এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল ১ এপ্রিল থেকে। কিন্তু করোনাভাইসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। তার আগে এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেলেও আটকে যায় এইচএসসি পরীক্ষা। মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও পরীক্ষা নেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি না হওয়ায় গত ৭ অক্টোবর এক সাংবাদিক সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনীর মতো এইচএসসি পরীক্ষাও নেওয়া যাচ্ছে না।
এরপর অষ্টমের সমাপনী এবং এসএসসির ফলাফলের গড় করে ২০২০ সালের এইচএসসির ফল নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। জেএসসি-জেডিসির ফলাফলকে ২৫ এবং এসএসসির ফলকে ৭৫ শতাংশ বিবেচনায় নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষিত হল। কিন্তু আইনে পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশের বিধান থাকায় তা সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বিশেষ পরিস্থিতিতে পরীক্ষা ছাড়াই ফল প্রকাশের বিধান যুক্ত করে গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদে আইন সংশোধন করতে হয়।
সংসদে পাস হওয়া তিনটি বিলে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সই করার পর সোমবার রাতে ‘ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট-২০২১’ বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (সংশোধন) অ্যাক্ট-২০২১’, ‘বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (সংশোধন) অ্যাক্ট-২০২১’ গেজেট আকারে জারি করে সরকার। তথ্য সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম।