‘একজন নানু মিয়া’ – শামীমা রিতু।

আমি ইদানিং খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।অবশ্য তা ইচ্ছে করেই। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে আমি খুব পছন্দ করি, যতক্ষণ সহ্য করতে পারি ব্যস্ত রাখি কোন না কোন কাজে। আজো তার ব্যতিক্রম হয়নি।কাজ ছাড়া জীবনটা নিরানন্দ মনে হয়।যদিও আমি আন্তর্জাতিক মানের অলস।
আমার কাজ বিভিন্ন রকমের, তা সম্পাদন করতে হয় মূলত তিনটা বিভাগে । বিকালের সময় টা আমার সব থেকে প্রিয় বিভাগ রেডিওর জন্য বরাদ্ধ।এখানে আমি কোন ছাড় দেইনা। ব্যস্ততার আড়ালেই আমি আমার আমিকে লুকিয়ে রাখি। পরিচিত জনরা আমাকে খুব স্নেহ করেন তবে নিন্দুকেরা ও কম যান না।তারা বিনে পয়সায় আমার প্রচার প্রচারনা চালিয়ে যান।তাতে অবশ্য আমার কোন মাথা ব্যাথা নাই।নাটঢিলা মানুষের মাথা থাকলেও ভিতরে তার ঠিক ঠাক মত কাজ করেনা বলেই পরের কথায় চিলে কান নিয়ে দৌড়ায়না।
আসল কথায় আসি,আজ সকালে কলেজে গেলাম একটা জরুরি কাজে।কাজটা শেষ করে রিক্সায় আসতে হলো।কিন্তু সমস্যা হলো কোন রিক্সাই পাওয়া যাচ্ছেনা।অনেক সময় পর একটা রিক্সা পেলাম।মুরব্বির ধরনের লোকটার বয়স আনুমানিক পঁচাত্তরের বেশি হবে। জীর্ণ শীর্ণ শরীর মুখে সাফা দাড়ি।দারিদ্রতার কষাষাঘাতে জর্জরিত দেখলেই বোঝা যায়। রিক্সায় জিনিসপত্র তুলে বসলাম।খুব খারাপ লাগলো বৃদ্ধ লোকটির জন্য, এ বয়সে উনি আর যাই করুক রিক্সা চালানোর মত পরিশ্রমের কাজ করার কথা নয়। কিছু দূর গিয়ে নিজে থেকেই কথা বলা শুরু করলাম। –
-চাচা বাড়ি কইরেব? নাম কিতা?
– বাড়িগো মাই সোনাপুর। নাম নানু মিয়া।
– আপনার হুরুতা নাইনি রেব?
– আর রে মাই হুরুতা! চাইর ফুরি তিন ফুয়া। দুই ফুরি বিয়া দিছি। তিন নম্বরটার বিয়ার মাত চলের।আর ফুয়াইনতে গো মাই আমরারে দেখত পারেনা।
– ইয়া, আপনার তো অখন রিক্সা চালাইবার বয়স নায়রেব।ইতা তো হুরুতায় ঠিক কররা না।
– পেটর জ্বালায় বয়স মানেনা গো মাই।জানে মানেনা এরপরেও চালানি লাগে।
অবাক হলাম। সাত সাতটি সন্তান থাকার পরও উনাকে ৭৫+ বয়সে রিক্সা চালাতে হয়। শাহআলম সরকারের একটা গানের কথা মনে পড়লো,
“কপাল দোষে সাত পোলার বাপ ভিক্ষা করে খায়
কপাল গুনে এক পোলার বাপ রাজার থালে খায়।”
আহারে সন্তান! কতো লোকের ঘর ভাঙ্গে এই সন্তান না থাকার জন্য আবার কেউ কেউ সন্তানের ঘরেই থাকতে পারেনা। এমন নিষ্ঠুর পৃথিবী আমাদের। কথায় কথায় জানতে পারলাম উনার পরিবারে বর্তমানে চারজন লোক।উপার্জন করেন একমাত্র তিনি। বয়সের ভারে অসুখেও ভর করেছে।
আমাদের সমাজে সিনিয়র সিটিজেনরা একসময় খুব অবহেলায় পড়ে যান। বয়সের দাপটে যারা সময়কে সময় মনে করতেন না তারাই মুখ থুবড়ে পড়েন শেষ।বয়সে। অনেক সন্তান ই বাবা মায়ের সাথে এসকল আচরণ করে থাকেন। যা খুব দুঃখজনক। স্বাভাবিক ভাবে এমন বয়ষ্ক কাউকে দেখলে আমার মনখারাপ হয়।
কথায় কথায় আমি বাসা পর্যন্ত চলে আসলাম।বিদায়ের সময় লোকটাকে অল্প কিছু টাকা বাড়তি দিয়ে বললাম।
-চাচা আমারও দেওয়ার মত কুন্তা নাই, টেকাগুলা রাখইন, যিতা মনে চায় খাইলিবা।
লোকটার মুখে যে হাসিটা ফোটলো তা অনেক দামী। টাকা দিয়ে সে হাসি কেনা যায়না। কতো ধনী ধনী লোকেরা গরিব মানুষকে ঠকাচ্ছে।অবহেলা অপমান করছে। সেখানে এ আর ওমন কি! যৌতুকের জন্য আটকে আছে নানু মিয়ার দুই কন্যার বিয়ে! একজন রিক্সা চালকের কাছে হাত পাত্তেও আজ বিবেকবোধ কাজ করেনা এমনি ডিজিটাল হয়েছি আমরা! যারা মুুখে বড় বড় বুলি আওড়ায় তারাই সব থেকেকে বেশি অন্যায় করে বেড়ায়। লোকটির কান্নাভেজা কণ্ঠের কাছে নিজেকে এক পরাজিত সন্তান মনে হলো। শিক্ষিত হওয়া আর মানুষের মত মানুষ হওয়া এক কথা নয়। সুযোগ পেলে শিক্ষিত হয়া যায় কিন্তু মানুষ হওয়া সাধনার বিষয়। কতো নানু মিয়ারা কলের চাকার মত চলছে এ সমাজে ; আমরা নাকি ঘুমের মধ্যেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি। অবচেতন মন জানতে চায় -! নানু মিয়ারা কেন ঘুমের মধ্যে নিজের অজান্তেই বড় লোক হয়ে যায়না;কেন তাদের বৃদ্ধ বয়সে রিক্সা ঠেলতে হয়!