#সাহিত্য ও সংস্কৃতি

দহন —- রিফাত মুনির ইতি

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ ওমর ফারুক দীর্ঘক্ষন রোগীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার সামনে বসা রোগীর বয়স ৩৬ , যদিও তাকে তেমন দেখাচ্ছে না, ভদ্রলোক পরিপাটি করে নিজেকে বয়স আরো কমিয়ে রেখেছেন!

বলুন, মিষ্টার আলী।
নাভিদ প্রস্তুত ছিল, বরাবরের মত, মুখ খুলল,
আচ্ছা, আমাকে দেখে আপনার কি মনে হয় বলুন তো?
ডাক্তার ঘাবড়ে গেলেন না। তার দীর্ঘদিনের চিকিৎসা কর্মে এমন পরিস্থিতির সাথে তিনি পরিচিত ।
ভালো, সাধারণ একজন।
স্বাভাবিক কি না? নাভিদ উৎসুক হয়ে উঠলো
অবশ্যই, অস্বাভাবিক ভাবার তো কোন কারন নেই!
কিন্তু ডক্টর, আমি একজন অস্বাভাবিক মানুষ ।
মানে?
মানে অন্যদের চোখে। বিশেষত: আমার স্ত্রীর কাছে।
তাই নাকি ?
জ্বি স্যার!

তাহলে খুলেই বলি গত মাসের ১৯ তারিখে আমার একমাত্র ছেলে মারা গেছে।
ও দুঃখিত!
মারা গেছে করোনায়। না ভয় পাবেন না, আমার হয়নি, আমি দীর্ঘদিন আইসোলেশনে ছিলাম। যদিও হবার কথা!
মানে ?
আমি ওর খুব কাছাকাছি ছিলাম । নভিদ থামলো। গলাটা সামান্য ভেজা ভেজা ।
আসলে হয়েছে কি, আমার স্ত্রীর সাথে আমার সেপারেশন হয়ে গেছে মাস প্রায় বছর খানেক হলো। ছেলের কাস্টডি দাবী করে কেস চলছে। আপাতত : আদালতের আদেশে ছেলে ওর মায়ের কাছে তিন দিন আর বাকি চারদিন থাকত।
ওর মা আসলে তিনদিন ও পায়না , আইন খুব শক্ত, কিন্তু আমিই ছাড় দিয়েছি! তাও ছেলের দিকে তাকিয়ে ।
নাভিদ দম নিলো। ডঃ ওমর নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলেন তার দিকে ।

তারপর হলো কি, আমার এখানে এসে তার কোভিড ধরা পড়ল। ও তার আগে বলে নেই, আমাদের সেপারেশন ছেলেটার ওপর খুব প্রভাব ফেলেছিল। ছোট্ট ছেলে, সাড়ে তিন বছর বয়স। বলতো কি , তুমি মা’র সাথে কবে মিলে যাবে আমি জানি । আমি চলে যাবার পর!
আমি পাত্তা দেইনি । ভালকথা, আমার স্ত্রীর সাথে আমার হেন বিষয় নেই যেটা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়নি। মূলত, আমাদের সংসারটাই ছিল অসম। মনে করেছিলাম সন্তান পরিবর্তন আনবে, তা হয়নি। আমরা তেমনই থেকে গেলাম ।
তো যা বলছিলাম, ছেলেটার প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা শুরু করেছিলাম আমি। বাইরে জানাইনি। পুরো ফ্ল্যাট হয়তো লক ডাউন করে দিতে পারে! মাকে দেখতে চাইছিল খুব, বলেছিলাম সেরে উঠলে নিয়ে যাবো। ওর মায়ের আসাও সম্ভব যাতে না হয় , সেই ব্যবস্থা করেছিলাম । আমার ছেলে , যা করার আমি করবো এমন একটা জেদ চেপে বসেছিল আমার ওপর।

আরেকবার দম নিল নাভিদ।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি । বাচ্চাটা চলে গেল। ওর মা , শুনেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, তার এক কাজিনের ক্লিনিকে ভর্তি ছিলো পাঁচ দিন।আমি প্রতিদিন গিয়েছি। গত পরশু ওকে বাসায় নিয়ে এলাম । সেই থেকে তার ধারনা আমি মানসিক ভাবে অসুস্থ, আপনি বলুন আপনার কি মনে হচ্ছে আমি তেমন?
বলুন???!
উত্তরের অপেক্ষা না করে একটু হাসি দিয়ে বলল, আসলে আমি শুধু কষ্ট পেয়েছি আমাদের এই একসাথে থাকাটা ছেলেটা আমার দেখে যেতে পারলো না!
আহা!!!!
ডঃ ফারুক খুব ভালো ভাবে দেখতে লাগলেন রোগীকে। সামান্য ছলছল করে ওঠা জল ছাড়া ও চোখে আর কিছু নেই।
হয়ত তার মাধ্যমেই শিশুটার প্রতি পরম ভালবাসায় আবেগ নিয়ন্ত্রনের পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন লোকটা।

মানুষ কত ভাবেই না পোড়ে! নিঃশব্দে …

রিফাত মুনীর ইতি
বাসা নং : ৪১/৫
রোড নং# ০১
ব্লক # এ
চাঁদ আবাসিক এলাকা , মোহাম্মদপুর
ঢাকা ।

1 Comment

  1. মোহাম্মদ হানিফ।
    24th Aug 2020 Reply

    দেশে তালাকের হার বেড়েই চলেছে। সংসার ভাংছে।সামাজিক অস্থিরতা, প্রগতিশীলতার নামে নারী স্বাধীনতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক-বলগ-টুইটারে আসক্তি, পর পুরুষের প্রতি নারীর আসক্তি, সামাজিজ ও নৈতিক অবক্ষয়, ব্যক্তিত্বের দ্বনদ্ব ইত্যাদি কারণে এ বিচ্ছেদ ঘটছে। এই বিচ্ছেদে পুরুষের চেয়ে নারীরাই করছেন বেশি। আর শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা বিবাহ-বিচ্ছেদে এগিয়ে রয়েছেন। এক জরিপে দেখা গেছে ৭০ দশমিক ৮৫ ভাগ নারী এবং ২৯ দশমিক ১৫ ভাগ তালাক দিচ্ছেন পুরুষরা। মোবাইল কোম্পানিগুলোর নানা অফার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ফেসবুক এবং পর্নোগ্রাফির মতো সহজলভ্য উপাদান থেকে আকৃষ্ট হয়ে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা হারাচ্ছেন। ফলে বিয়ের মতো সুদৃঢ় সম্পর্ক এবং নৈতিক বিষয়টি ছিন্ন করতে একটুও দ্বিধা করছেন না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *