#সম্পাদকীয়

সেই পুরনো মার্কিননীতি !

গত কয়েক দশকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ভূমিকা বারবার এমনভাবে প্রকাশ পেয়েছে যেখানে তারা প্রথমে আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ করে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নিজেরাই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। ইরানকে ঘিরে সাম্প্রতিক ইরান-ইজরায়েল সংঘাতে মার্কিন হস্তক্ষেপ এবং তার পরপরই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এই পুরনো চিত্রকেই নতুন করে সামনে এনেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে একটি চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য হলো, তারা প্রায়ই সামরিক অভিযানের মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শনের পর অল্প সময়ের মধ্যেই কূটনৈতিক সমঝোতায় যেতে চায়। এ ধরনের দ্বৈত অবস্থান অনেক সময় দ্ব্যর্থবোধক মনে হলেও, বাস্তবে এটি একটি সুপরিকল্পিত কৌশল। এই প্রতিবেদন সেই কৌশলগত পুনরাবৃত্তির বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রথাগতভাবে মধ্যপ্রাচ্যে যেসব সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তা অধিকাংশ সময়ই সীমিত উদ্দেশ্য পূরণের জন্য। তাদের লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষকে বার্তা দেওয়া বা প্রতিরোধ গড়ে তোলা, কিন্তু কখনোই পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ নয়। ইরান একটি আঞ্চলিক শক্তি হওয়ায়, তার বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়ালে যুক্তরাষ্ট্রকে অপ্রত্যাশিত জটিলতায় পড়তে হয়। এই পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য তারা দ্রুত একটি নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চায় না। ইরাক ও আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা মার্কিন সমাজে যুদ্ধবিরোধী মানসিকতা তৈরি করেছে। প্রেসিডেন্ট ও নীতিনির্ধারকরা এই মনোভাবের প্রতি সংবেদনশীল। গণমাধ্যম দ্রুত যুদ্ধের মানবিক দিকগুলো তুলে ধরে, যা প্রশাসনের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। একইসঙ্গে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি ও করদাতাদের উদ্বেগও যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রাখে।

ইরান মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত। তার সঙ্গে সংঘাত শুরু হলে হিজবুল্লাহ, হুথি বিদ্রোহী এবং অন্যান্য শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর ফলে যুদ্ধ একটি আঞ্চলিক অগ্নিসংযোগে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। একইসঙ্গে ইসরায়েল, সৌদি আরবসহ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে। এ কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি কিছু আরব রাষ্ট্রও যুদ্ধ থামানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করে। এই আন্তর্জাতিক চাপ যুক্তরাষ্ট্রকে দ্রুত যুদ্ধবিরতির পথে ঠেলে দেয়।

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাত শুরু হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কারণ, ইরান হরমুজ প্রণালী দিয়ে বৈশ্বিক তেলের একটি বড় অংশ সরবরাহ করে। এই অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হলে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং এর প্রভাব পড়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। যুক্তরাষ্ট্রে তেলের দাম বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়, যা অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। ফলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ সীমিত রাখতে বাধ্য হয়।

১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র পারস্য উপসাগরে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করে এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি আহ্বান করে। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের ইরাক যুদ্ধের সময় ইরানের প্রভাব মোকাবেলায় তারা পরোক্ষ সমঝোতার পথ খুঁজেছিল। ২০১৯ সালে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার পর যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করা হয়। ২০২০ সালে জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। ২০২৫ সালে ইরান-ইজরায়েল সংঘর্ষেও একই রকম দৃশ্য দেখা গেছে — সামরিক হামলার পর সপ্তাহ না ঘুরতেই যুক্তরাষ্ট্রই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত কৌশল — একদিকে আক্রমণ, অন্যদিকে শান্তি — আসলে একটি পরিকল্পিত ক্ষমতা-সন্তুলনের কৌশল। এতে তারা একদিকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব বজায় রাখে, অন্যদিকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের ঝুঁকি এড়িয়ে চলে। এই কৌশল ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে এবং বর্তমানেও তা অব্যাহত রয়েছে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *