‘মনিকা’ – শামীমা রিতু।

সেদিন বিকেলে খুব তাড়াহুড়া করে হাঁটছিলাম, কাজটাও ছিলো জরুরী। হুট করে পেছন থেকে গাড়ির হর্ণ আর ডাক শুনলাম –
-তুমি কি শিফাত?
– হাসি মুখে বললাম হ্যা।কিন্তু তুমি?
– আমি মনিকা। অনেক দিন পর তোমাকে দেখলাম।সময় আছে?চলো কোথাও গিয়ে বসি।
না বলতে পারলাম না। সামনের কফিশপে ঢুকলাম।মফস্বল শহর, সবাই সবার মুখচেনা। তাই ঢুকতেই ওয়েটার হাসিমুখে বললো কি থাবেন আপারা?
অর্ডার দিলাম কফি আর সিঙারা। মনিকা হাসলো –
বললাম হাসছিস যে?
– নাহ! সিঙারা এখনো তোর প্রিয়ই রয়ে গেলো।
আমি হাসলাম, বললাম এটা হলো মধ্যবিত্তের জাতীয় খাবার, এটাকে অপমান করে উক্তি করা ঠিক না। মনিকা হেসে বললো, কখনো তোর সাথে কথায় পারিনি আর পারবও না। ভাগ্যিস তুই যুক্তিবিদ্যা পড়িস নি?
-তোকে কে বললো যে আমি যুক্তিবিদ্যা পড়িনি? হ্যা একাডেমিক ভাবে যুক্তিবিদ্যা বা দর্শন আমার সাবজেক্ট ছিলোনা তার মানে এটা নয় যে আমি সেটা পড়িনি। কফি আসলো, সিঙারায় কামড় দিলাম।
তারপর বল তোর খবর কি? কি করছিস আজকাল?
– কি আর করবো, দীর্ঘশ্বাস মনিকার। এসিল্যান্ড হয়ে গরিব মানুষ কে সরকারে জায়গা থেকে উচ্ছেদ করি, বড়লোকদের উচ্ছেদে বিভিন্ন প্রেসার থাকে সে সব সামাল দেই, মোটা টাকা বেতন পাই, সরকারি বাড়ি গাড়ি এই সব নিয়ে আছি।
– বাহ! তারপরেও দীর্ঘশ্বাস কেন?
– তোর মতো বাউন্ডুলে হতে পারলে বেঁচে যেতাম তাই!
– হাসলাম! বলে কী?
– সত্যি রে!
বাদ দে, সংসারের কথা বল?
– হুম সংসার আছে বটে একটা। চালাতে হয় তাই চলে। তুই কি আজীবন এমন থাকবি?
– ক্ষতি কি? ভালই তো আছি। মুক্ত পাখির মত উড়ে বেড়াই, নায়াগ্রার মতো ছন্দে আনন্দে ঝরে পড়ি…
– সেটা ঠিক। আজ আসি সন্ধ্যা হয়ে এলো।
মনিকা গাড়ি নিয়ে নিঃশব্দে চলে গেলো।আমি হাঁটা ধরলাম।
মনিকা আর আমি একসাথে পড়তাম।আমাদের গভীর বন্ধুত্ব ছিলো। কলেজের উত্তাল সময়গুলো আমরা একসাথে আনন্দে কাটিয়েছি। একটা গ্যাং এর মধ্যে আমিই ছিলাম হাবা টাইপের। এখন সবাই খুব ভাল ভাল জব করে। আমি আপাতত বেকার সময় কাটাচ্ছি। ইচ্ছা হলে কাজ করি না হলে করিনা। মানুষের জীবন বদলাতে খুব বেশি কিছু লাগেনা, আর না হয় অনেক কিছুর প্রয়োজন। আমি অবাক হলাম! আমিও কতো বদলে গেছি! শহীদ মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন,মানুষ বদলায়, কারনে অকারনে বদলায়।
মনিকার অনেক কথাই আমার জানা ছিলো। সে একজন কে খুব ভালবাসতো। মনিকা মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়ে।কখনো পার্টটাইম জব,কখনো টিউশনি করে তার পড়ালেখা চালিয়েছে।আজ সে অনেক কিছুই পেয়েছে কিন্তু যা হারিয়েছে তা কখনোই ফিরে পাবার মতো নয়! জীবনে অনেক অপমানিত হয়েছে মনিকা। উন্মে সালমা আরা মনি নামে আরেকটা মেয়ে ছিলো।সে প্রচুর ড্রাগ নিতো।আমরা তখন শুনতাম কিন্তু বুঝতাম না। যেদিন ও মারা গেলো, মনিকা চুপটি করে ক্ষীনস্বরে বলেছিলো – মনি বেঁচে গেলো আর মনিকা পৃথিবীতে রইলো। সেদিন বুঝিনি কিন্তু এখন বুঝি কতটা কষ্ট পেলে মানুষ পাথর হয়!
তার কয়েকমাস পরের ঘটনা। এমনি এক বিকেলে বসে আছি। পুরাতন এক বন্ধু জানালো মনিকা বিয়ে করেনি। আমি স্বভাবসুলব বললাম -সেটাতো ওর বিষয়। সে ধমকে বললো, তুই তো দুনিয়ায় থাকিস না। অরন্য ওর সাথে কি করেছিলো ভুলে গেলি? উত্তরে বললাম না ভুলিনি, মনিকা অরন্যে অনেক রোদন করেছিলো, কেউ শুনেনি। তো এখন আবার পুরাতন ঢাক নতুন করে বাজানোর কারনটা কি শুনি?
সে মনেহয় রেগে গেলো, ধমকের গলাটা চড়িয়ে বললো, এক পাগলের কাছে আরেক পাগলের কিচ্ছা গেয়ে লাভ নাই- ফোনটা কেটে গেলো!
সে যাক, জীবনে কতো ফোন ই তো কাটলো। তাতে কি বা আসে যায়! মনিকা বিয়ে করেনি সেটা আমি জানতাম, ওকে কষ্ট না দেয়ার জন্য বিষয়টা সেদিন তুলিনি। আজ ওর খ্যাতি টাকা সম্মান সব আছে, কিন্তু সে যা চেয়েছে তার কিছুই পায়নি! মানুষের চাওয়াটা বড় আযব! কখনো দামি কিছুতে মন আটকায়না, কখনোবা কমদামী জিনিসের জন্য হাহাকার করে। সে যাকগে, আমি বাসায় ফিরলাম।ইচ্ছে হলো ফেলুদা পড়বো,কিন্তু আমার মুডসুইং বেশি হয় তাই ফেলুদাকে বদ্ধ করে ছোটগল্প নিয়ে বসলাম।শরৎচন্দ্রের ছোটগল্প। বিলাসী, বিন্দুর ছেলে,অরক্ষণীয়া, পরিণীতা শেষ করলাম। কবিতার বই হাতে নিলাম।মন খারাপের সময়ে কবিতার বই অনেক ভালো কাজে দেয়।কিন্তু কিছুতেই মাথা থেকে মনিকার কথা ভুলতে পারছিলাম না। একটা মানুষ কি করে এতকিছু সহ্য করতে পারে! কীভাবে নিজেকে শেষ করতে পারে তিলে তিলে!
রাত গভীরতর হয়! আমি কানপেতে শুনি রাতজাগা পাখিদের ডানা ঝাপটানি, রাতের কুয়াশার শব্দে বিভোর হয় আমার মন, কোকিলের কুহু ডাক অসহ্য লাগে আমার! সে তো শুধু বসন্তেই থাকে! কিন্তু ঝড়বাদলের দুঃসময়ে কোথায় থাকে তার এই মধুরতা? আমি জানি মনিকা এখন হয়তো ঘুমের ঔষধ খেয়ে নাক ডাকছে, কিংবা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে অতীত কে মুছার চেষ্টা করছে। চাইলেই কি আর অতীত মুছা যায়? হয়তো দূরে রাখা যায়, অস্বীকার করা যায় কিন্তু ভুলে থাকা যায় কী? মানুষ যে বলে আমি এটা ভুলে গেছি, অমুক কে ভুলে গেছি, আসলে কি তাই হয়?
কোন শাস্ত্রই এটা স্বীকার করেনা যে মানুষ ভুলতে পারে, তবে কারো সাইকোলজিক্যাল বা নিউরোলজিক্যাল ফ্যাক্ট থাকলে ভিন্ন বিষয়। বরং কিছু ক্ষেত্রে যতদিন যায় সেসব মনে পড়ে বেশি। কেউ কাউকে ভুলতে পারে না শুধু সময়ের আড়াল করে রাখে। মনিকাও তেমনি সময়ের আড়ালে রেখেছে। আচ্ছা অরন্য কি ওকে ভুলে গেছে? হয়তোবা! নয়তোবা! মানুষ তো সবকিছুই পারে,বরং স্বার্থসিদ্ধি হয়ে গেলে তা আরো বেশি পারে। রাত বাড়ে, আমি নিঃশব্দ হয়ে পড়ি…।