#সাহিত্য ও সংস্কৃতি

গনি সাহেবের সমুদ্র ভ্রমণ ….!

সৈয়দ মিনহাজুল ইসলাম :

বাসে ভীড়টা একটু বেশিই মনে হচ্ছে আজ। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ফুসফুসটা অতিরিক্ত অক্সিজেনর জন্যে হাসফাস করছে, কিন্তু পাবো কোথায় ? গনি সাহেবের মুখটা আরেকজন ভদ্রলোক যে কিনা তার থেকে আধ হাত লম্বা তার পিঠে থেতলে আছে। মাথা নাড়ানোর কোনো সুযোগই নেই। দুটো পা কোনো রকমে একটু জায়গা করে নিয়েছে মেঝেতে আর একটা হাত ঝুলছে রেলিংয়ে। প্রতিদিন বাঁদুড় ঝুলা হয়ে অফিসে যেতে হয় – এর আর নতুন কি ! কিন্তু আজকে বড্ড বেশি চাপ। আশে পাশের গুঞ্জন থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছে মালিক-শ্রমিকের বিবাদের কারণে গাজীপুর – গুলিস্তান রুটের বাস চলছে না। এই এক যন্ত্রনা ! মালিকের সাথে শ্রমিকের দ্বন্দ্ব বা সরকারের সাথে মতের অমিল দেও বাস বন্ধ করে। ভুক্ত ভুগি জনগণ যার এমনিতেই হাজারো সমস্যা, তার কাঁধে আরেকটু বোঝা চাপিয়ে দাও।
ফার্মগেট প্রায় এসে পরেছে । গনি সাহেব নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু নিজের এই ছোট খাটো দেহটা কিভাবে বের করে নিয়ে আসবেন তাই ভাবছেন। অনেক কষ্টে নিজের মাথাটাকে কারো পিঠে কারো বুকে ঘসে নিয়ে কোনো মতে বেরিয়ে হাঁফ ছাড়লেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছে হাঁটা দিলেন অফিসের উদ্দেশ্যে।

গনি সাহেবের পরিচয়টা এবার দেয়া যাক। বয়স : আনুমানিক ৫০, একটা বেসরকারী বীমা কোম্পানিতে উচ্চতর করনিকের চাকরি করছেন প্রায় ১৫ বছর ধরে। দুই সন্তানের জনক। মেয়ে মাধ্যমিক দিবে আগামী বছর আর ছেলে সবে উচ্চ বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেছে।
স্ত্রী আলেয়া ঘর করনার পাশা পাশি সেলাইয়ের কাজ করেন। এতে তাদের আটপৌরের সংসার ভালই চলে।

গনি সাহেবের একার আয়ে ঠিক সামলানো যাচ্ছিলনা। ছেলে মেয়ে বড়ো হচ্ছে। জিনিস পত্রের দাম ক্রমশই বেড়ে চলেছে। খুব কষ্ট হচ্ছিলো গনি সাহেবের তাল মেলাতে। ভাগ্যিস ! আলেয়ার মাথায় বুদ্ধিটা এলো। সেলাইতো সে আগেই জানতো। বাচ্চাদের জন্য ছোটবেলায় অনেক পোশাক তৈরী করে পড়িয়েছে। এখন আর ওরা পড়তে চায় না। মায়ের তৈরী করা পোশাক পুরোনো নকশার বলেই ওদের ধারণা ! আমাদের পাড়াতেই এক ভদ্রমহিলা অনেকদিন ধরে সেলাইয়ের কাজ করে আসছেন। বিভিন্ন দর্জিখানা থেকে কাজ নিয়ে এসে ঘরে পোশাক তৈরী করেন। বেশ ভালো আয় হয়। ঈদ এবং পুজোতে আয়ের পরিমান দ্বিগুণ হয়ে যায়। ওই ভদ্রমহিলাই আলেয়াকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই ই নয়, নতুন সেলাই মেশিন কেনার জন্য বিনা সুদে টাকা ধার দিয়েছেন। আলেয়া তার ভীষণ ভক্ত। আলেয়াকে কোথাও যেতে হয়না। ভদ্রমহিলা বাসায় এসে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যান আবার সময় মতো তা সংগ্রহ করেন। সংসারের যে বাড়তি প্রয়োজনগুলি তৈরী হয় তা আলেয়ার টাকাতেই আসে। এমনকি বাচ্চাদের বায়না মেটানো, আত্মীয় স্বজনের বিয়ে জন্মদিনের উপহার সামগ্রী এই সবই মেটে আলেয়ার আয় দিয়ে।

গনি সাহেবের চাহিদা খুব সামান্য। সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করা। ছুটির দিনে সাধ্যমত একটু ভালো মন্দ খাওয়া, জামা জুতো ছিড়ে গেলে চলন সই কিছু একটা কিনে নেওয়া। আহামরি কোনো কিছুই তার চাহিদার মধ্যে ছিলো না। ছেলেবেলা থেকে এতো না এর সাথে যুদ্ধ করেছেন যে চাহিদা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগই পায়নি। তবে একটা বিষয়ে তার খুবই আগ্রহ, সেটা হচ্ছে ভ্রমণ। ঘুরে বেড়াতে তার খুব ইচ্ছে করে। নতুন নতুন জায়গায় যাওয়া। সেখানকার মানুষ, পরিবেশ, কৃষ্টি, জীবন যাত্রা এসব দেখতে তার খুব ইচ্ছে হয়। বাংলাদেশের দুই একটা জেলা ছাড়া আর কিছুই তার দেখা হয় নাই এ পর্যন্ত। এমনকি ঢাকা জেলাটাও ঠিক মত দেখা হয়নি। ঘুরে বেড়াতে অনেক টাকা লাগে। একাতো যাওয়া যায় না আর সবাইকে নিয়ে ক্ষমতায় কুলোবে না। এই ইচ্ছের কথাটা কখনো কাউকে বলা হয়নি। অবশ্য বলার মতোও তেমন কেউ নেই। আলেয়াকে লজ্জায় বলা হয় না। মেয়েটা অনেকদিন ধরেই বলছে শীতের ছুটিতে কক্সবাজার নিয়ে যাবার জন্য। সঙ্গত কারণেই আলেয়া বিষয়টা এড়িয়ে যাচ্ছে। তবে আমার ধারণা ও অল্প অল্প করে টাকা জমাচ্ছে এবং কোনো একদিন সবাইকে চমকে দিয়ে বলবে ‘চলো সবাই মিলে সমুদ্র দেখে আসি ‘। ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠে। কল্পনায় ভেসে উঠে – যাবার প্রস্তুতির তোড় জোড় চলছে। আলেয়া দেখে দেখে সব জিনিস পত্র ব্যাগে ভরছে, সবাইকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে সকাল সকাল উঠতে হবে। তূর্ণা নিশীথা সকাল ৮টায় কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে ছাড়বে। আমাদেরকে সাড়ে সাতটার মধ্যে গিয়ে পৌঁছাতে হবে ইত্যাদি ।
বিশাল জলরাশি। অনেক দূর থেকে উঁচু হয়ে সৈকতে আছড়ে পড়ছে। বাচ্চা দুটো পানিতে দাপা দাপি করছে। আশে পাশে অনেক লোকজন। কেউ বালিতে বসে আছে , কেউ হাটু পানিতে নেমে ছবি তুলছে, কেউবা আবার ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে ককটেল জুস্ খাচ্ছে। গনি সাহেবেরও স্বাদ হয়েছিলো অমন একটি চেয়ারে বসে আলেয়াকে নিয়ে ককটেল জুস্ খাওয়ার, কিন্তু দাম শুনে ওনার সকল ইচ্ছে কর্পূর হয়ে উড়ে গেছে। যাগ্গে, তাতে কি ? গনি সাহেব বালির ছোট্ট এক ডিবিতে চাদর বিছিয়ে আধ শোয়া হয়ে বাদাম চিবুচ্ছেন, তার আলেয়া পাশে বসে উল দিয়ে সুয়েটার বুনছেন। সমুদ্রের শীতল হাওয়ায় শরীরটা অবস হয়ে আসছে, চোখের পাতা দুটি আস্তে আস্তে নিচের দিকে নেমে আসছে !

স্যার. … স্যার ….
গনি সাহেব সংবিৎ ফিরে পেয়ে তাকালেন !
বড় স্যার আপনারে ডাকে, বলেই পিয়ন উল্টো দিকে হাঁটা ধরলো। সমুদ্র ভ্রমণের ভাবনায় কখন যে চোখটা লেগে এসেছিলো টেরই পাননি ?
গনি সাহেবের বুকটা দুরু দুরু করতে লাগলো। না জানি কেন এই অসময়ে ম্যানেজার স্যার ডেকে পাঠিয়েছেন ? এক গ্লাস পানি খেয়ে ছুটলেন ব্যবস্থাপকের কক্ষের দিকে।

স্যার আসবো ?
আসুন গনি সাহেব। বসুন।
গনি সাহেব আড়ষ্ট হয়ে চেয়ারে বসলেন। ভীত চোখ দুটি বড় সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে।
বড় সাহেব একটা ফাইল হাতে নিয়ে একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন –
আপনাকে গত মাসের পলিসি রিনিউ এর আপডেট দিতে বলেছিলাম ? এটা কি দিয়েছেন ? গনি সাহেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ম্যানেজার বলে চললেন –
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম জনপ্রতি ৪২০ টাকা
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার লাগবে ২৫০ টাকা
হোটেল প্রতি রুম ১০০০ টাকা।
একরুমে ৪জন থাকা যেতো, কিন্তু কর্তৃপক্ষ রাজি হবে না !!
বড় সাহেব কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন – এসব কি দিয়ে গেছেন ?
গনি সাহেবের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে এলো, ভয়ে কথা বেরুচ্ছে না।
বড় সাহেব বললেন – এটা নিয়ে যান। আজকের মধ্যেই আমার আপটুডেট রিপোর্ট চাই।
গনি সাহেব কোনো মতে বলতে পারলেন – জি স্যার।
বড় সাহেবের কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। মনে মনে বললেন বড় বাঁচা বেঁচে গেছি, ভাগ্যিস, খাবার দাবারের ফিরিস্তি লিখিনি – তাহলে মান সম্মান আর অবশিষ্ট থাকতো না কিছুই …..!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *