হিন্দু – মুসলিম দ্বন্দ্ব !

বাংলাদেশী বেশির ভাগ মানুষ এবং বেশির ভাগ মুসলিম মূলত ভারত বিরোধী, কিন্তু হিন্দু বিরোধী নয় । এমনকি বাংলাদেশী অনেক হিন্দুও ভারত বিরোধী । কারণ, ভারত অনেক ভাবেই বাংলাদেশের উপর অত্যাচার করে, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে বা করতে চায় । যদিও ভারত আমাদের স্বাধীনতায় সাহায্য করেছিল । সেটা স্বাধীন দেশের প্রতি শ্রদ্ধা থেকে নয়, পশ্চিমবঙ্গে একাত্তরে দেড় কোটি শরণার্থীর ঠেলা থেকে বাঁচতে । যেমনটা এখন আমরা রোহিঙ্গাদের থেকে বাঁচতে চেষ্টা করছি । পারলে আমরা রোহিঙ্গাদের আলাদা একটি স্বাধীন দেশ করে দিয়ে হলেও এদের থেকে বাঁচি । সান্তনা পুরষ্কার হিসাবে ভাসানচরে খাঁচা বন্দি করে রাখি ।
ভারত বিরোধিতা এবং হিন্দু বিরোধিতা এক নয় । একটি রাজনীতি, আরেকটি ধর্ম । বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ কখনোই কোনো ধর্মের বিরোধী নয়, বিদ্বেষীও নয় । হিন্দু হোক, মুসলিম হোক, বৌদ্ধ হোক, বাংলাদেশের মানুষ নিরীহ ধর্ম ভীরু । যার যার ধর্মটা কেবল পালন করে একটু ভালো থাকতে চায় ।
এ দেশের হিন্দুদের বেশির ভাগ নিরীহ হিন্দু, জাতি ভেদে নিম্ন বর্ণের, এদেশের মুসলিমদের বেশির ভাগ হিন্দু ধর্ম থেকে মুসলিম ধর্মান্তরিত হওয়া দরিদ্র কৃষক, মুঘল আমলে জমি আর ঘর বাড়ির লোভে উত্তর ভারত থেকে আসা উদ্বাস্তু মুসলিম, নিরীহ ফকির দরবেশদের হাতে কেবল কলেমা পড়া মুসলিম, এ দেশের বৌদ্ধরা ছিল এক সময়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে পালিয়ে আসা নিরীহ বৌদ্ধ । তাই এখানে কখনো ধর্মগুলোর পরস্পরের বিদ্বেষ রূপটি প্রকট ছিল না ।
সময়ে বদলে যায় । শুরু হয় রাজনীতির খেলা ।
উপমহাদেশে রাজনীতি আগে, ধর্ম পরে । উপমহাদেশে রাজনীতির কারণে ধর্মটা ব্যবহার হয়, ধর্মের কারণে রাজনীতি এদেশে কখনোই ছিল না ।
উপমহাদেশে ধর্ম বিদ্বেষী রাজনীতির শুরু বিশ শতকের শুরুতে । প্রথম শুরু কংগ্রেস – মুসলিম লীগ দিয়ে । বাহিরে দিনের বেলা ব্রিটিশ তাড়ানোর স্ট্র্যাটেজি, ভেতরে রাতের বেলা একই ব্রিটিশের সাথে দু পক্ষেরই সুবিধা আদায়ের তদবিরবাজি ।
সরাসরি ধর্মের কারণে রাজনীতি এদেশে প্রথম আনে মওদুদী । ১৯৪১ সালে ভারতে মওদুদী জামায়াতে ইসলামী হিন্দ গঠন করে, পরবর্তীতে ৪৭ এ পাকিস্তানে চলে যায় এবং জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান বানায়, সেটার আরেকটি ব্রাঞ্চ জামায়াত বাংলাদেশ ।
বিশ্ব মুসলিম রাজনীতিতেও ধর্মের ব্যবহার শুরু কাছাকাছি সময় । প্রথম শুরু হয় ১৯২৮ এ মিশরে মুসলিম ব্রাদার হুড দিয়ে । সত্তরের দশকে প্যালেস্টাইন-ইজরাইল যুদ্ধটাও যতটা ধর্মের ছিল, তার চেয়ে ছিল আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ দ্বন্দ্ব । প্যালেস্টাইনে বসবাস অনেক আরব ইহুদি এবং খ্রিষ্টানও প্যালেস্টাইন মুসলিমদের মতো অত্যাচারিত হতো ইজরাইল এ আগত বাহিরের ইহুদীদের দ্বারা । পরবর্তীতে আরবরা ভূ রাজনীতির স্ট্রেটিজিতে ইজরায়েলের সাথে জড়িয়ে গেলে ইসলামকে সামনে নিয়ে এসে ধর্মের রাজনীতি শুরু করে মুসলমানরা। ৭৯ তে ইরান বিপ্লব ধর্মকে রাজনীতির জন্যে ব্যবহারের ষোলকলা পূর্ণ করে । ওটাও ছিল ইসলামিস্ট আর কমিউনিস্টদের যৌথ ক্ষমতার মুভমেন্ট শাহের বিরুদ্ধে । একুশ শতকের আফগান, আমেরিকান টুইন টাওয়ার, তালেবান, প্রত্যেকটাই রাজনীতির জন্যে ধর্মের ব্যবহার ।
মুঘল সম্রাট আকবর সংখ্যা লঘিষ্ঠ মুসলিম হয়ে সংখ্যা গরিষ্ঠ হিন্দুদের উপর প্রভাব খাটাতে হিন্দু বিয়ে করেছিল । কারণ কিছুই নয়, ক্ষমতাই আসল; ধর্ম নয় । এখানেও রাজনীতির জন্যে ধর্মের ব্যবহার ।
৪৭ এর দেশ ভাগ উপর থেকে দেখলে মনে হয় ধর্ম । কিন্তু সত্যটা এখন সবাই জানে । কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, ধর্মটা কেবল হাতিয়ার ।
৭১ এ আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধটা একটি ব্যাতিক্রম । পাকিস্তানিরা ধর্মের বল দিয়ে আমাদের ঘায়েল করতে চেয়েছিল । আমরা ধর্মের বল কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার নিচে এক হয়ে পাকিস্তানি এবং ধর্ম, দুটোকেই ছুঁড়ে ফেলে দিলাম । কারণ বাঙালির কোনো ধর্ম নেই । বাঙালির ধর্ম তার প্রথম ভাষা, তারপর কালচার । হিন্দু মুসলিম দুজনেই ভাত মাছ খায়, বাংলায় কথা বলে । ধর্মের কারণে বাংলাদেশ হয় নি । হয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ।
ভারতের মতো তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাংলাদেশে কখনো হয় নি, হবেও না । কারণ, বাংলাদেশের মুসলিমরা প্রতিবেশী দেশকে পছন্দ করে না তাদের আচরণে, অত্যাচারে; কিন্তু প্রতিবেশী হিন্দুকে কখনো অপছন্দ করেন না ।
সামাজিক ভাবে বাংলাদেশী হিন্দু-মুসলিম পার্থক্য করা যায় না । এদেশে হিন্দু-মুসলিম দু পক্ষেরই পুরুষরা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে, মেয়েরা শাড়ি-ব্লাউজ পরে । এদেশের একটি মুসলিম বিয়ের অনুষ্ঠান আর হিন্দুর বিয়ের অনুষ্ঠান প্রায় একই । ধর্মের সামান্য আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া ।
পাশের দেশ এবং নিজেদের মধ্যে কিছু জীবাণু বর্তমানের ভেদটি ছড়াচ্ছে । জীবাণু অল্প লোকে ছড়ায়, কিন্তু ভুক্তভুগী হয় অনেক লোক ।
জীবাণুটি ভারত ।
যদিও আমি ব্যাক্তিগত ভাবে কোনো দেশ বিরোধিতার বিপক্ষে । কারণ, একটি দেশের সব মানুষ ভুল করে না, কিছু রাজনৈতিক মানুষ ভুল করে ।
এদেশের হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি নষ্ট হতে ভারত যেমন জীবাণুর উৎস, তেমনি ভারত সমাধানও । ধর্ম একটি উছিলা মাত্র ।
সমাধানটি রাজনীতিরই করতে হবে, কারণ, সমস্যাটি ধর্মের নয়, রাজনীতির ।
লেখকঃ ডা. অপূর্ব চৌধুরী।
চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক ।
লন্ডন – যুক্তরাজ্য।