#পাঠক সমাচার

আম্মা আমার আম্মা — আফিয়া বেগম শিরি

কিছুতেই ঘুম আসছে না। মনটা খুবই খারাপ, ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার দিয়ে কাঁদি। আজ ছয় মাস ধরে মা কে আমার ঘরে এনেছি। এক সাথে হাসিখুশী করেছি। মায়ের পাশে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গল্প করেছি। মনে শান্তনা ছিলো মাকে চোখের সামনে দেখছি, এইতো পরম শান্তি। কিছু হলে অন্তত পাশে আছি।
এতদিন শুধু এটা ওটা করোনা ভাইরাসের অজুহাত দেখিয়ে যেতে দেইনি। কিন্তু আজ আর পারলাম না। উনি বাবার রেখে যাওয়া ৩৫ বছরের ঘরে কয়েকদিন থাকতে চান। জীবনের শেষ বয়সে মায়ের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করতে পারি না। সব সময় উনার একটাই কথা, তোমাদের বাবার ঘরটা ভীষণ মিস করি। আমি কয়েকটা দিন থাকার পর আবার চলে আসব। আসলে আমি যতই রাগ গোস্বা দেখাই না কেনো, মনে সব সময় যেতে না দেয়ায় অপরাধ বোধ জাগে। কী জানি শেষ বয়সে হয়তো বাবার স্মৃতি টাকে হাতড়ে শান্তনা পান। মায়ের ঘরে আরো দুই জন সদস্য আছেন যারা কাজের জন্য বেশীর ভাগ সময় বাহিরে থাকতে হয়। দেখাশুনার ব্যাপারে তারাও যথেষ্ট কেয়ারিং কিন্তু আমার মন সব সময় উদ্বিগ্ন থাকে। বয়স হয়েছে,এভাবে থাকাটা সেইফ হচ্ছে কী না। আমি চাই মা যতদিন বেচে আছেন স্হায়ী ভাবে আমার কাছে থাকুন। তবে কথা দিয়েছেন উনি আবার আসবেন। আমার ঘর থেকে উনার ঘর দেখা যায়। দিনে অন্তত বিশ বার যেতে পারি।

লেখাটি এই ভাবনা থেকে লিখছি। আগেকার দিনে দেখতাম মা বাবার বয়স হলে অথবা দুজনের একজন গত হয়ে গেলে সন্তানরা আর্থিক কিংবা সামাজিক সামর্থ্য অনুয়ায়ী তাদের পাশের ঘরে রাখার ব্যবস্হা করতেন । জায়গার যদি সংকুলান না হয় তবে বারান্দা ঘরে একটি ছোট রুম সাজিয়ে ছোট নাতী /নাতনীকে নিয়ে থাকার ব্যবস্হা করে দিতেন। তবুও একা থাকতে দিতেন না।

বর্তমান সময়ে আমরা তার উল্টোটি দেখছি। ছেলে ছেলের বউ কর্মজীবি হলে তো কথাই নেই। কর্ম স্হলের সুবিদার্থে আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে হবে। আর যদি উচ্চ শিক্ষার জন্য বাহিরে পাঠিয়ে দেয়া হয় কিংবা বিদেশে চাকুরীজীবি হয় তবে পরিবার সহ একেকটি সন্তান একেক দেশে সেটেল হয়ে যায়। বৃদ্ধ বাবা মা একা দেশের বাড়িতে বুয়ার সাহায্যে জীবন যাপন করতে হয়। যাদের মা /বাবার একজন গত হয়ে যান তাদের অন্যজন বাকী জীবন বৃদ্ধাশ্রমে কাটাতে হয় যা খুবই মর্মান্তিক।

অনেক ডকুমেন্টারীতে দেখা যায় পিতা মাতা সন্তানদের লালন পালন প্রাচুর্য্যের মাঝে বড় করে শেষ আশ্রয়স্হল বৃদ্ধাশ্রমের স্বজনবিহীন একটি রুমে চোখের জলে বেঁচে থাকার যন্ত্রনা। বাবার রেখে যাওয়া এক টুকরো ছাদের প্রতি যদি মায়ের এতো মমতার প্রভাব পড়তে পারে তবে যারা জীবনের সর্বাত্নক শ্রম দিয়ে অর্জিত সম্পদ ভিটে মাটির মায়া ত্যাগ করে বৃদ্ধাশ্রমে দিন যাপন করছেন তাদের মানসিক অবস্হা কি হতে পারে?
ইউরোপের দেশগুলোতে এটা স্বাভাবিক বলে গণ্য করা হয়। বয়স্করা স্বাধীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত। যতদিন পর্যন্ত শারীরিক অক্ষমতা না আসে ততদিন তারা কারো উপর ভরসা করে শেষ জীবন কাটাতে চায় না। নির্দিষ্ট সময়ে নিজের জন্য বরাদ্দ করে রাখা কেয়ার হোমে চলে যায়।

সময় যেমন বদলেছে তেমনি বদলেছে মানুষের মন মানসিকতা। নতুন প্রজন্মরা খাদ্যভাস পাল্টিয়ে রেডিমেইড খাবারের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। নিজের মত করে থাকতে চাইছে। ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তাদের চিন্তা ধারা যুক্তিযুক্ত। আমরা বেঁচে থাকলে সন্তানদের উপর নির্ভরশীল হওয়াটা কতটুকু যৌক্তিক। মনের দিক থেকে প্রস্তুতি নিলেও সময়ে কি তা সহনীয় হবে।

আফিয়া বেগম শির
কবি ও লেখক
যুক্তরাজ্য

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *