#ইসলাম ও জীবন দর্শন

কোরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষা।

মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই কোরবানির বিধান চলে আসছে। প্রত্যেক ধর্ম মতেই কোরবানি ছিল একটি অপরিহার্য অংশ। মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম আ:-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। আন্তরিকতা ও উদ্দেশ্যের সততার কারণে হাবিলের কোরবানি কবুল হলো, কিন্তু নিষ্ঠার অভাব ও অমনোযোগিতার কারণে কাবিলের কোরবানি প্রত্যাখ্যাত হলো। কোরবানির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন হজরত ইব্রাহিম আ: ও ইসমাইল আ:।

মহান আল্লাহর জন্য হজরত ইব্রাহিম আ:-এর সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগ এবং হজরত ইসমাইল আ:-এর আত্মোৎসর্গ আল্লাহর কাছে এতই পছন্দ হলো যে, তিনি ইব্রাহিম আ:-কে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলেন। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ তাকে মুসলিম জাতির পিতার আসনে অভিষিক্ত করলেন এবং তার ছেলে ইসমাইল আ:-এর পবিত্র বংশ দ্বারাই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আবির্ভাব ঘটালেন। তিনি হজরত ইব্রাহিম আ: ও হজরত ইসমাইল আ:-এর ত্যাগের ইতিহাস চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য সর্বকালের সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানি বাধ্যতামূলক করলেন।

ঈদুল আজহা মুসলিম দুনিয়ার সর্বত্র পালিত হয় নানা নামে। যেমন- মিসরে একে বলা হয় ঈদুল বাকারা, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে একে বলা হয় ঈদে কুরবান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান প্রভৃতি অঞ্চলে বকরা ঈদ, বাংলাদেশে সাধারণত একে বলা হয় কোরবানির ঈদ, তুরস্কে বলা হয় কুরবান বায়রাম, অ্যারাবিয়ান গালফ এলাকায় ইয়াওমুন নাহর। ঈদ মানে পুনরাবৃত্ত আনন্দ উৎসব। এই ঈদে পশু কোরবানি দেয়া সামর্থ্যবানদের জন্য ওয়াজিব। কোরবানিকৃত পশুর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিব মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করতে হয় যাতে তারাও এই আপ্যায়নে শরিক হতে পারে। পশু কোরবানির মাধ্যমে শয়তান প্ররোচিত পাশবিকতা দূর হয়। এর দ্বারা তাকওয়া অর্জিত হয়।

আমাদের জীবন, আমাদের সম্পদ সব কিছু মহান আল্লাহর দান। মহান আল্লাহর জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে পারাই কোরবানির গুরুত্ব। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে তার প্রিয় বান্দার গোলামি প্রকাশ পায়, প্রভুর জন্য তার ভালোবাসা ও ত্যাগের মহিমা বর্ণিত হয়। আল্লাহর দান আল্লাহকে ফিরিয়ে দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত, তার একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষা হলো কোরবানি। ঈদুল আজহা কেবল পশু কোরবানি করা এবং আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে আনন্দ প্রমোদকে বুঝায় না বরং ঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আত্মোৎসর্গ করা। নিজের ভেতরে থাকা পশুত্বের মূলোৎপাটন এবং একমাত্র রবের সন্তুষ্টি।

ঈমান আনার মাধ্যমে সবাই মুমিন বা মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ঈমান গ্রহণের সাথে সাথেই প্রতিটি মুমিন ইসলামের সব বিষয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে। সুখ দুঃখ এবং সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় ইসলামই একমাত্র অনুশাসন এ কথাটি নিজের মধ্যে দৃঢ় করে নেয়া। প্রকৃত মুমিনের মৌলিক চিন্তা-চেতনা এমন হওয়াটাই কাম্য। ঈদ মুসলিম এবং প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে আনন্দ খুঁজে পাওয়ার অনন্য মাধ্যম।

ইসলাম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ধর্ম। এর প্রতিটি আদেশ নিষেধের সাথে জড়িয়ে আছে মুসলিমদের আত্মা পরিশুদ্ধ করা এবং প্রশান্ত করা। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি এ কথাটি সবার মুখে রটে বেড়ায় কিন্তু ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শিক্ষা এবং এর মহত্ত্বের প্রতি ক’জনইবা গুরুত্ব দিচ্ছি! ঈদ যেমনি আনন্দের বার্তা দিচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষা দিচ্ছে মহান আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার। নিজের মাঝে থাকা পশুত্ব ও অমানবিক মন মানসিকতা বিসর্জন দেয়ার। বার্তা দিচ্ছে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর। সুপথ দেখাচ্ছে ন্যায়নীতি আর নিষ্ঠার পথে চলার।

শিক্ষা দিচ্ছে সুন্দর ও পবিত্র মনের অধিকারী হওয়ার। তাই আসুন ঈদুল আজহার প্রকৃত মহত্ত¡ ও তাৎপর্য নিজে লালন করতে শিখি। অসুন্দর ও কলুষিত হৃদয় পবিত্র করার লক্ষ্যে ঈদুল আজহায় শিক্ষা গ্রহণ করি। করোনার এই দুর্যোগ ও মহামারীতে অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। অন্য সময় দান সদাকাহ এবং সহযোগিতার পরিমাণ যেটুকু ছিল এখন সেটা আরো বাড়াতে চেষ্টা করি। সবিশেষ সবার প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই।

কোরবানির উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন ইচ্ছা ও অহঙ্কারমুক্ত হতে হবে। অনেকেই বাহবা পাওয়ার জন্য ও নাম জাহির করার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার পশু কিনে লাল ফিতা বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শিত করে থাকেন এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কম দামি দুর্বল পশু কোরবানিও অনুচিত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেটা আল্লাহর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। পশুর গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না বরং তাকওয়া আল্লাহ কবুল করে থাকেন। ভোগ নয়, ত্যাগেই আনন্দ- এটি কোরবানির অন্যতম শিক্ষা।

কোরবানির গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটানো কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। রাসূল সা: কোরবানির তিন ভাগের একভাগ গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। এমনকি সবটা দান করাও বৈধ। কোরবানির গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ বৈধ তবে গরিবদের মাঝে বিতরণের যে উদ্দেশ্য তা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। শুধু পশু নয়, নিজের অন্তরের পশুত্ব কোরবানি করাও কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সাথে আমাদের ভিতরের পশুত্বকেও কোরবানি করতে হবে।

এ কোরবানি কেবল যে পশু কোরবানি নয়, তা মানুষের ভেতরের অহঙ্কারী পশুর, মানুষের ভেতরের রক্তাক্ত অমানুষের বিনাশের প্রতীকী ত্যাগ। এর সাথে সাথে এ বিশাল ত্যাগের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি অন্যতম প্রয়াস এই কোরবানি। এতে ব্যক্তির দেহের ও মনের ঋণাত্মক যত ভাবনা, অমানবিক যত চেতনা, মানবিকতার পরিপন্থী যত উপলব্ধি ও অহঙ্কার এবং মানুষের মনের অন্তর্গত হিংস্র পশুত্বের যে অপচ্ছায়া তা অপসারিত হয়। এটাই নজরুলের কবিতায় উঠে আসা কোরবানির মর্মগাথা। এ ধারায় নজরুলের ‘বকরি ঈদ’ (সওগাত, ১৩৩৪) কবিতাটিও বিষয়-প্রাসঙ্গিকতায় অভিন্ন। এ কবিতাটি উপলব্ধির অন্তঃপুরে ত্যাগের মহিমাকে শোভান্বিত করে তুলেছে। এ কবিতায় নজরুল কোরবানির ঈদ মানবিক চেতনায় মহিমান্বিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছেন, ‘শহীদানের ঈদ এলো বকরীদ।…তাহারাই শুধু বকরীদ করে জানমাল কোরবানে।’

মহান আল্লাহর তাওহিদ বা একত্ববাদ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। কারণ, একমাত্র বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহর উদ্দেশে, তার নামেই পশু কোরবানি দেয়া হয়। কোরবানির গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আল্লাহর সব আদেশের সামনে বিনা প্রশ্নে মাথানত করে দেয়াই হলো পূর্ণ আত্মসমর্পণের সমুজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ।

ঈদুল আজহার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা হজরত ইব্রাহিম আ: ও তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল আ:-এর এরূপ পূর্ণ আত্মসমর্পণের চিত্রই পবিত্র কুরআনুল কারিমে দেখতে পাই। সব কাজে ইখলাস বা একনিষ্ঠতাই ইসলামের মহান শিক্ষা। ইখলাস ছাড়া পরকালীন কোনো কাজই আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না। আন্তরিকতা ও ভালোবাসা-বর্জিত ইবাদাত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র। তাই কোরবানিও একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোরবানির সুমহান শিক্ষা তাকওয়াভিত্তিক জীবনযাপন। জীবনের সব ক্ষেত্রে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনই মুমিনের প্রকৃত সফলতা।

বস্তুত আল্লাহ তায়ালা তার আমলকেই কবুল করেন, যার আমলে তাকওয়া বা খোদাভীতির সন্নিবেশ ঘটেছে। হজরত আদম-পুত্র হাবিলের কোরবানি আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছিলেন তাকওয়ার প্রভাবের কারণেই। কোরবানির অন্যতম শিক্ষা দরিদ্র ও অনাথের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হওয়া। ঈদুল আজহার নামাজে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্র-ইয়াতিমের মধ্যে কোরবানির গোশত বণ্টন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, আমাদের সম্পদে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের অধিকার রয়েছে। কোরবানি মুসলমানদের শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং পরিশুদ্ধ জীবনগঠনের নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনও বটে। এর মাধ্যমে মুসলমান তাওহিদী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এবং ইখলাস ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের অপূর্ব নজির স্থাপন করতে পারে।

দেশের অর্থনীতির সাথে কোরবানির এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। তাই প্রসঙ্গত এ নিয়েও সবসময় ভাবনা কাজ করে। সে ভাবনা থেকে করোনাভাইরাস চতুর্থ ঢেউ এবং বন্যাজনিত কারণে এবারের পশু কেনাবেচা এবং পশুর চামড়া কেনাবেচায় বড় ধরনের ধাক্কা সামলাতে হবে আমাদের। যে ধাক্কা সামলাতে না পারলে সোজা আঘাত হানবে দেশের অর্থনীতিতে। জিলহজ মাসের ১০ তারিখে মুসলমানদের অন্যতম একটি উৎসব ঈদুল আজহা পালিত হবে। প্রতি বছর এ সময়ের আগেই বাংলাদেশে গরু-ছাগল কেনাবেচা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। ভারত থেকে অবৈধ পথে গরু আসা অনেকটা কমে যাওয়ার পর গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ জুড়ে বহু ছোট-ছোট খামার গড়ে উঠেছে, যার মূল লক্ষ্য থাকে কোরবানির পশুর হাট। গ্রামাঞ্চলে বহু পরিবার শুধু কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য গরু-ছাগল লালনপালন করে। কিন্তু এবারের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন হতে পারে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এবার গরু-ছাগল কেনাবেচা নিয়ে এক ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে।

২০২০, মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনেকটা স্থবিরতা নেমে এসেছে। বহু মানুষ হয়তো চাকরি হারিয়েছে নতুবা তাদের আয় কমে গেছে। যাদের আয় আছে তারাও স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনা করে পশু কোরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কিনা-সন্দেহ আছে। করোনাভাইরাসের ঝুঁকি, বন্যাজনিত নোংরা-দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ থাকায় এবার অনেকটা অস্বস্তিতে পশু বেচাকেনা হবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেক খামারি। বিভিন্ন ডিজিটাল হাট থেকে ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও লাখ লাখ টাকা দিয়ে অস্থায়ী পশুর হাট ইজারা নেয়া ব্যবসায়ীরা লোকসানের আশঙ্কা করছেন। সব মিলিয়ে স্বস্তির চেয়ে অস্বস্তির ছাপটাই বেশি দেখা যাচ্ছে এবারের কোরবানিতে।
কোরবানির পশু যদি বিক্রি কম হয়, তবে লোকসানের সম্মুখীন হতে হবে খামারিদের। সেই সাথে এবার চামড়ার বাজারও ধসে পড়বে। এতে করে দেশের অর্থনীতি অনেকখানি ধাক্কা খাবে।

পরিশেষে এ কথা বলতে পারি যে, ঈদুল আজহা উপলক্ষে লাখ লাখ পশু কোরবানি হবে। পশুর চামড়া সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণে পরিবহন শৃঙ্খলাসহ পশু জবাইয়ের পর পশুর রক্ত, ময়লা আবর্জনায় যাতে পরিবেশ নোংরা না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। কেননা এতে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি ও হুমকিতে পতিত হয়ে করোনা পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলতে পারে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়গুলোতে বিশেষ নজর দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ।
কলামিস্ট, সাবেক উপ-মহাপরিচালক
বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *